হাওজা নিউজ এজেন্সি: দোয়া মানুষের অন্তরকে প্রশান্ত করে এবং তার দৃষ্টি–চিন্তাকে কেবল দৃশ্যমান কারণ থেকে সরিয়ে আল্লাহর ক্ষমতা ও কুদরতের দিকে নিয়ে যায়—যিনি কুরআনের বর্ণনায় “সর্বোত্তম রিযিকদাতা”।
আহলে বাইত (আ.)–এর শিক্ষা অনুযায়ী, রিযিক শুধু অর্থ নয়। সুস্থতা, শান্তি, নেক সন্তান, উত্তম বন্ধু, নতুন সুযোগ, এবং ইবাদতের তাওফিকও রিযিকের অন্তর্গত। তবে মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যেহেতু আর্থিক ক্ষেত্রে, তাই রেওয়ায়েতে রিযিক বৃদ্ধির দোয়া, আমল এবং বরকতের উপায় ব্যাপকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আহলে বাইত (আ.)–এর দৃষ্টিতে রিযিকের প্রকৃত অর্থ
ইমাম আলী (আ.) রিযিককে দুই ভাগে ভাগ করেছেন—
১. যে রিযিকের সন্ধানে তুমি ছুটছ,
২. যে রিযিক তোমার দিকে এগিয়ে আসে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে অযথা দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা করে এবং স্মরণ করায় যে আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের অংশ নির্ধারণ করেছেন। তবে ইসলাম কখনো আলস্য শেখায় না; বরং বলে—কাজ করবে, চেষ্টা করবে, এবং পাশাপাশি রিযিক বৃদ্ধির দোয়া করবে, যাতে আল্লাহ অদেখা পথগুলো উন্মুক্ত করে দেন।
দৈনন্দিন জীবনে রিযিক বৃদ্ধির দোয়া
নবী করিম (সা.)–এর একটি প্রসিদ্ধ দোয়া:
اللّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلالِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَ أَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ
হে আল্লাহ! তোমার হালাল রিযিকে আমাকে হারাম থেকে বাঁচাও এবং তোমার অনুগ্রহে আমাকে মানুষের মুখাপেক্ষী না করো।
এই দোয়া হালাল উপার্জনের শিক্ষা দেয় এবং মানুষকে অপ্রয়োজনীয় নির্ভরতা থেকে মুক্ত করে। নৈতিকতাবিষয়ক আলেমরা বলেন—এই দোয়ায় অবিরত থাকা জীবিকার অপ্রত্যাশিত দরজা খুলে দেয়।
এর পাশাপাশি ইস্তিগফার অত্যন্ত কার্যকর। কুরআন বহুবার উল্লেখ করেছে—ইস্তিগফার রিযিক বৃদ্ধি করে এবং বরকতের দরজা খুলে দেয়। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন— “যে ব্যক্তি জীবিকায় সংকট দেখে, সে প্রচুর ইস্তিগফার করুক।”
তাই আলেমদের উপদেশ—দিন শুরু করা উচিত এভাবে:
أستغفرُ اللهَ رَبّي وأتوبُ إليه
—যা জীবিকার ওপর বরকত আনে।
ব্যবসা ও দোকানের জন্য রিযিক–বরকতের দোয়া
ব্যবসায়ীরা বাজারের মন্দা, ক্রেতা কমে যাওয়া এবং উপার্জনের সংকটে বেশি ভোগেন। রেওয়ায়েতে ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ দোয়া উল্লেখ আছে। দোকানে প্রবেশের সময় বলা সুন্নত:
بِسمِ اللّهِ، تَوَكَّلتُ عَلَى اللّهِ، لا حَولَ وَلا قُوَّةَ إِلّا بِاللّه
—আল্লাহর নামে শুরু করছি, তিনিই আমার ভরসা; শক্তি ও ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই।
এটি হৃদয়কে স্থির করে এবং নেতিবাচকতা দূর করে। অনেকে বলেন—এই দোয়া অপ্রত্যাশিত উপায়ে বরকত ডেকে আনে।
আরেকটি প্রসিদ্ধ দোয়া:
اللّهُمَّ ارزُقْنِي مِن فَضلِكَ وَ لا تُحَوِّجْنِي إِلَى غَيرِكَ
—হে আল্লাহ! তোমার অনুগ্রহ থেকে আমাকে রিযিক দাও এবং কাউকে আমার প্রয়োজনের মাধ্যম বানিও না।
এটি ব্যবসায় বরকত বৃদ্ধির জন্য বহুদিনের পরীক্ষিত দোয়া।
দোয়া ও ব্যবসার নৈতিকতা: বরকতের মূল চাবিকাঠি
রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে—সত্যবাদিতা, মিথ্যা শপথ এড়িয়ে চলা, ন্যায্য মূল্য রাখা এবং সদাচরণ—এসবই বরকতের প্রধান কারণ। বহু অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী বলেছেন—একটি সুন্দর আচরণ অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রমের চেয়েও বেশি রিযিক এনে দেয়।
দিনের শুরুতে বলা:
یا فَتّاح، یا رَزّاق
—হে সকল পথের উন্মোচনকারী, হে রিযিকদাতা!
এই জিকির জীবিকার গতি বাড়ায় এবং সাফল্যের দ্বার খুলে দেয়।
রিযিক বৃদ্ধির জন্য কুরআনের চার বিশেষ সূরা
আলেমদের মতে, রিযিক বৃদ্ধিতে চারটি সূরা বিশেষভাবে প্রভাবশালী:
১. সূরা ওয়াকিয়া—দারিদ্র্য দূর করে।
২. সূরা ইয়াসীন—জীবিকার জটিলতা দূর করে।
৩. সূরা লুকমান—পরিবারে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বরকত আনে।
৪. সূরা ফাতহ—সাফল্য ও অগ্রগতির দরজা খুলে দেয়, বিশেষত ব্যবসায়।
এই সূরাগুলো শুধু পাঠ নয়, বরং হৃদয় ও চরিত্রকে শক্তিশালী করার এক পথ।
ইস্তিগফারের মাধ্যমে রিযিক বৃদ্ধি
ইসলামী শিক্ষায় ইস্তিগফার রিযিক বৃদ্ধির সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়গুলোর একটি। কুরআন ইস্তিগফারকে বরকত, ধন–সম্পদ বৃদ্ধি, বৃষ্টিবর্ষণ ও পারিবারিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করেছে।
কুরআনে ইস্তিগফারের প্রভাব
সুরা নূহে বলা হয়েছে: “তোমরা প্রভুর কাছে ক্ষমা চাও; তিনি ক্ষমাশীল।
তিনি আসমান থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন,
এবং ধন–সম্পদ ও সন্তান দিয়ে তোমাদের শক্তিশালী করবেন…”
এটি দেখায়—আত্মিক পরিচ্ছন্নতা দুনিয়ার জীবনে বরকতের দরজা খুলে দেয়।
রেওয়ায়েতে ইস্তিগফারের গুরুত্ব
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন— “জীবিকায় সংকট দেখা দিলে ইস্তিগফার বৃদ্ধি করো।”
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— “যে ব্যক্তি বেশি ইস্তিগফার করে, আল্লাহ তার জন্য প্রতিটি দুঃখ থেকে মুক্তির পথ এবং প্রত্যেক সংকট থেকে রেহাই দেন, এবং অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে তাকে রিযিক দেন।”
রিযিক কেবল দেহগত শ্রমের ফল নয়; বরং ঈমান, নীতি, চেষ্টা, ইস্তিগফার, দোয়া এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতার সমন্বিত ফল।
ব্যবসার দোয়া, রিযিক বৃদ্ধির দোয়া, ইস্তিগফার, এবং চার সূরা—ইসলাম এসবকে জীবনে বরকতের পথ হিসেবে নির্দেশ করেছে।
যে ব্যক্তি কষ্টের মুখোমুখি হয়, তার জন্য দোয়া শুধু ইবাদত নয়—এটি আলো, যা পথ দেখায়, হৃদয়কে দৃঢ় করে এবং জীবনে সহজি আনয়ন করে। দোয়া যখন পরিশ্রম, সততা, পবিত্র নিয়ত ও ইস্তিগফারের সঙ্গে যুক্ত হয়—তখন রিযিকের দরজাগুলো এমনভাবে খুলে যায়, যা কেবল আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে।
আপনার কমেন্ট